বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব সাফারী পার্ক, গাজীপুর এর উদ্বোধন উপলক্ষ্যে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য


বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব সাফারী পার্ক, গাজীপুর এর উদ্বোধন অনুষ্ঠানের সভাপতি পরিবেশ ও বন মন্ত্রনালয়ের দায়িত্বে নিয়োজিত মন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ এম.পি ; অনুষ্ঠানের বিশেষ অতিথি অত্র এলাকার মাননীয় সংসদ সদস্য আলহাজ্ব এডভোকেট রহমত আলী এম.পি; পরিবেশ বন মন্ত্রণালয়ের সচিব শফিকুর রহমান পাটোয়ারী; বন অধিদপ্তরের প্রধান বন সংরক্ষক মোঃ ইউনুছ আলী; অনুষ্ঠানে উপস্থিত সূধীমন্ডলী এবং প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ার সাংবাদিক বন্ধুরা। সবাইকে আমার আন্তরিক শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন জানাচ্ছি। বন ও বন্যপ্রাণী আমাদের প্রাকৃতিক পরিবেশ, খাদ্যচক্র ও জীবনের মূল আধাঁর। বন ও বন্যপ্রাণীর সংরক্ষণের উপর অধিকতর গুরুত্ব প্রদানের জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭৩ সালে ‘‘বাংলাদেশ বন্যপ্রাণী (সংরক্ষণ) আইন’’ প্রণয়ন করেছিলেন। ভাওয়াল গড়ের শালবন ঐতিহাসিক ভাবে জীব-বৈচিত্র্যে ভরপুর ছিল। ছোট ছোট চালা ও বাইদ সমৃদ্ধ শালবনে এক সময় দেখা যেত আমলকি, বহেড়া, হরিতকি, কড়ই ও শিমুলসহ প্রায় ৬৩ প্রজাতির গাছপালা ও ২২০ প্রজাতির বন্যপ্রাণী। ঢাকা মহানগরীর অতি নিকটে নীরবতা খুঁজে নেয়ার জন্য পিকনিক ও পর্যটনের জন্য ছুটে আসত এ বনাঞ্চলে। কিন্তু জনসংখ্যা বৃদ্ধি, নগরায়ন, শিল্পায়ন, বন ধ্বংস করে কৃষি জমির বিস্তার, আবাসন, জবরদখল ও ভূমি বিরোধের কারণে শাল বনের জীববৈচিত্র্য দ্রুত হারিয়ে যাচ্ছে।

সূধীবৃন্দ ঃ

এই বনাঞ্চলকে সুরক্ষার জন্য জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭৩ সালে দেশের সর্বপ্রথম ভাওয়াল জাতীয় উদ্যান ঘোষণা করেন। বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন ছিল জাতীয় উদ্যানটিকে চিত্ত বিনোদন, শিক্ষা ও গবেষণার সুযোগ সৃষ্টির পাশাপাশি পর্যটন কেন্দ্রের রূপান্তর করবেন। কিন্তু ভূমি বিরোধ, জবরদখল ও শিল্প প্রসারের কারণে এ উদ্যানের জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ করা যায়নি। বর্তমান সরকারের নির্বাচনী ওয়াদা ও বঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত কাজ বাস্তবায়নে নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছে। ১৯৯৯-২০০০ সালে আওয়ামীলীগ সরকার কক্সবাজার জেলার চকরিয়ার উপজেলাধীন ডুলাহাজরায় ২২৩৭.০ একর এলাকা নিয়ে দেশের সর্বপ্রথম সাফারী পার্ক প্রতিষ্ঠা করা হয়। তারই ধারাবাহিকতায় ঢাকা থেকে মাত্র ৪০ কিলোমিটার দুরে গাজীপুরের এই ছায়াসুনিবিড় বনের ভিতর সাফারী পার্ক প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে। পরিবেশ পর্যটন (ঊপড়-ঃড়ঁৎরংস) কে উৎসাহিত করার লক্ষ্যে পৃথিবীর অনেক দেশে সাফারী পার্ক স্থাপিত হয়েছে। জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর স্মৃতি বিজড়িত ভাওয়ালগড় এলাকায় এ সাফারী পার্কটির আয়তন ৩৬৯০.০ একর যা এশিয়ার সর্ববৃহৎ সাফারী পার্ক। সম্মানিত সূধীবৃন্দ

এ সাফারী পার্কটি দক্ষিণ এশীয় মডেলে বিশেষ করে থাইল্যান্ডের ঝধভধৎর ডড়ৎষফ এর আদলে করা হচ্ছে। জুন/২০১০ সালে ৬৩.৯৯ কোটি টাকা ব্যয়ে কাজ শুরু হয়। ভূমি অধিগ্রহনের কাজে সিংহভাগ টাকা ব্যয় হয়। মাস্টার প্লানের আলোকে ২০১১ সালে সংশোধিত প্রকল্পে ২১৯.৮৯ কোটি টাকা অনুমোদন করা হয়। এ সাফারী পার্কে ১২২৫.০০ একর এলাকা নিয়ে কোর সাফারী (ঈড়ৎব ঝধভধৎর) ৫৬৬.০ একর সাফারী কিংডম (ঝধভধৎর করহমফড়স) ৮২০.০ একরের বায়োডাইভার্সিটি পার্ক (ইরড়ফরাবৎংরঃু চধৎশ), ৭৬৯.০ একরে এক্সটেন্সিভ এশীয়ান সাফারী (ঊীঃবহংরাব অংরধহ ঝধভধৎর) ও ৩৮.০ একর এলাকায় বঙ্গবন্ধু স্কয়ার স্থাপন করার কাজ চলছে। ইতোমধ্যে বন ও অবমুক্ত বন্যপ্রাণীর নিরাপত্তার জন্য ২৬ কিঃমিঃ মাস্টার বাউন্ডারী ওয়াল নির্মাণ করা হয়েছে। আজ পর্যটকদের কোর সাফারীতে গাড়ী করে অবলোকন জন্য বাঘ, সিংহ, সাদা সিংহ, ভল্লুক, চিত্রা হরিণ, মায়া হরিণ, সাম্বার হরিণ, জেব্রা, জিরাফ, ওয়াইল্ডিবিষ্ট, ব্লেসবক উটপাখী ইত্যাদি অবমুক্ত করা হয়েছে।

বাংলাদেশের বন ও প্রাণীবৈচিত্র্য সম্পর্কে ধারনা দেয়ার জন্য একটি আর্ন্তজাতিক মানের প্রকৃতি বীক্ষণ কেন্দ্র নির্মাণ করা হয়েছে। এছাড়া তথ্য ও শিক্ষাকেন্দ্র, নেচার হিষ্ট্রি মিউজিয়াম, পার্ক অফিস, বিশ্রামাগার, ডরমেটরী, বন্যপ্রাণী হাসপাতাল, কুমির পার্ক, লিজার্ড পার্ক, ফেন্সি ডাক গার্ডেন, ক্রাউন ফিজেন্ট এভিয়ারী, প্যারট এভিয়ারী, ধনেশ পাখিশালা, ম্যাকাউ ল্যান্ড, পর্যবেক্ষন টাওয়ার, ফোয়ারা, বাঘ পর্যবেক্ষন রেস্তোরা, সিংহ পর্যবেক্ষন রেস্তোরা ও ফুডকোর্ট ইত্যাদি চালু হচ্ছে। পর্যটকদের ভ্রমনের সুবিধার জন্য ২টি বাস ও ২টি সাফারী জীপ চালু থাকবে।

চলমান কাজের মধ্যে রয়েছে মেরিন একুরিয়াম, অর্কিড হাউজ, প্রজাপতি বাগান, ফেন্সি কার্প গার্ডেন, কচ্ছপ প্রজনন কেন্দ্র, ঝুলন্ত ব্রীজ, ইকো-রিসোর্ট, এলিফেন্ট শো গ্যালারী (ঊষবঢ়যধহঃ ঝযড়ি এধষষবৎু), বার্ড শো গ্যালারী (ইরৎফ ঝযড়ি এধষষবৎু), এগ ওয়ার্ল্ড ও শিশু পার্ক ইত্যাদি। আমি এ প্রকল্পের অগ্রগতিতে সন্তোষ প্রকাশ করছি।

উপস্থিত সূধীমন্ডলী

আমরা আমাদের নির্বাচনী ওয়াদা ও বঙ্গবন্ধুর আদর্শ বাস্তবায়নে নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছি। আমরা সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীতে ১৮ (ক) ধারা সংযোজনের মাধ্যমে বাংলাদেশের বন, বন্যপ্রাণী, জীববৈচিত্র্য ও পরিবেশকে সংরক্ষণের উপর গুরুত্ব প্রদান করেছি। ইতোমধ্যে বন্যপ্রাণী (সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা) আইন-২০১২মহান জাতীয় সংসদের মাধ্যমে পাশ হয়েছে এবং কার্যকর হয়েছে। আমরা বাঘ সংরক্ষণের জন্য টাইগার এ্যাকশন প্ল্যান ২০০৯-২০১৭ প্রণয়ন করেছি। বন্যপ্রাণী বিশেষ করে বাঘ ও হাতির আক্রমনে নিহত বা আহত পরিবারের মানবিক সাহায্যের জন্য ২০১০ সালে ক্ষতিপূরণ বিধিমালা প্রণয়ন করা হয়। গত ২ বছরে ১০০টি পরিবারকে ৯২.০ লক্ষ টাকা ক্ষতিপূরণ প্রদান করা হয়েছে। বন্যপ্রাণী সংক্রান্ত শিক্ষা, গবেষণা ও সংরক্ষণ কার্যক্রমকে উৎসাহিত করার লক্ষ্যে ২০১০ সাল থেকে ইধহমধনধহফযঁ অধিৎফ ভড়ৎ ডরষফষরভব ঈড়হংবৎাধঃরড়হ পদক প্রবর্তন করা হয়েছে।

বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ কার্যক্রমকে আরো বেগবান ও অবৈধভাবে বন্যপ্রাণী পাঁচার ও শিকার রোধকল্পে বিশ্ব ব্যাংকের আর্থিক সহায়তায় ২৭৫.০০ কোটি টাকা প্রাক্কলিত ব্যায়ে ‘স্ট্রেংদেনিং রিজিওনাল কো-অপারেশন ফর ওয়াইল্ডলাইফ প্রটেকশন’ প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হচ্ছে এবং এই প্রকল্পের আওতায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব সাফারী পার্কে একটি বন্যপ্রাণী উদ্ধারকেন্দ্র স্থাপন করা হয়েছে যেখানে অসুস্থ ও আহত বন্যপ্রাণীকে চিকিৎসাসেবা প্রদান করা হচ্ছে। আপনারা জানেন ১৯৭৩ থেকে ২০০৮ সাল পর্যন্ত দেশে সর্বমোট ১৭টি রক্ষিত এলাকা (জাতীয় উদ্যান ও অভায়রন্য) ঘোষণা করা হয়। বর্তমান আওয়ামীলীগ সরকারের আমলে বিগত ৫ বছরে সারাদেশে ২০টি এলাকাকে রক্ষিত এলাকা ঘোষণা করা হয়। বন্যপ্রাণী ও জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণের ক্ষেত্রে এটি সরকারের একটি যুগান্তকারী পদক্ষেপ। সারাদেশে ৩৯টি রক্ষিত এলাকায় ইকোট্যুরিজম উন্নয়ন ও জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণের লক্ষ্যে ‘স্ট্রেংদেনিং রিজিওনাল কো-অপারেশন ফর ওয়াইল্ডলাইফ প্রটেকশন’ প্রকল্পের অর্থায়নে বিভিন্ন কার্যক্রম বাস্তবায়নের কাজ চলছে। এ ছাড়া বাংলাদেশ সরকারের অর্থায়নে ৪৮ কোটি টাকা ব্যায়ে ‘বাংলাদেশের জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ ও ইকোটুরিজম উন্নয়ন’ প্রকল্প বাস্তবায়নাধীন রয়েছে।

সূধীবৃন্দ,

আপনারা সকলে জানেন ঢাকা মহানগরীর আশেপাশে বার্ধত জনগোষ্ঠির চাহিদা অনুসারে পরিবেশ পর্যটন ও চিত্তোবিনোদনের সুযোগ নাই। এ পার্কটি প্রতিষ্ঠা হওয়ার ফলে সারাদেশের জনগণ চিত্তোবিনোদন, শিক্ষা ও গবেষণার সুযোগ পাবেন। এখানে একদিকে যেমন ক্ষয়িঞ্চু শাল বনের উদ্ভিদ বৈচিত্র্যতা ফিরে আসবে অন্যদিকে বিভিন্ন ধরনের বিরল ও বিলুপ্ত প্রায় দেশী-বিদেশী বন্যপ্রাণীর বংশ বৃদ্ধির সুযোগ সৃষ্টি হবে।

আমি অত্র এলাকার মাননীয় সংসদ সদস্য আলহাজ্ব এ্যাডভোকেট রহমত আলী ও স্থাণীয় জনসাধারণকে সাফারী পার্ক প্রতিষ্ঠায় সহযোগীতা করার জন্য আন্তরিক ধন্যবাদ জানাচ্ছি। পার্ক প্রতিষ্ঠা হওয়ার ফলে সড়ক যোগাযোগ ও বিদ্যুৎ সঞ্চালন লাইন চালু হয়েছে। এলাকাবাসী দীর্ঘ দিনের দাবী গ্রামবিদ্যুৎতায়ন ও সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থা উন্নয়ন করার জন্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে নির্দেশনা দিচ্ছি।

সাফারী পার্ক প্রকল্পের সাথে সংশ্লিষ্ট পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয় এবং বন অধিদপ্তরের প্রকল্প পরিচালক, কর্মকর্তা ও কর্মচারী নিরলসভাবে এ পার্কটিকে দৃষ্টিনন্দন ও প্রাণীবৈচিত্র্যে ভরপুর করে পর্যটকদের আকৃষ্ট করার কাজে নিবেদিত আছেন বিধায় আমি তাদের ধন্যবাদ জানাচ্ছি। এছাড়া পার্কের অভ্যন্তরের ৪১০.০ একর ভূমি অধিগ্রহনের কাজ সফলভাবে সম্পন্ন করেছেন বিধায় গাজীপুর জেলার প্রশাসনকে ধন্যবাদ জানাচ্ছি। আমি বিশেষ করে ধন্যবাদ জানাচ্ছি বাংলাদেশ সেনাবাহিনীকে পার্কের অভ্যন্তরে অবস্থিত ডেমোলিশন গ্রাউন্ডটিকে স্থানান্তর করে বিকল্প এলাকায় স্থাপন করেছেন। পর্যটকদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য পুলিশ প্রশাসন সহযোগীতা করবেন বলে আমি আশা করি। আমি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব সাফারী পার্ক, গাজীপ্রু এর শুভ উদ্বোধন ঘোষণা করছি।

উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে উপস্থিত সূধীবৃন্দ, সাংবাদিক ও এলাকবাসীকে ধন্যবাদ জানিয়ে আমি আমার বক্তব্য শেষ করছি।

জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু। বাংলাদেশ চিরজীবী হোক।